পৃথিবীর গ্রেটদের তালিকায় তাঁর পিতা বঙ্গবন্ধুর নামটিও অগ্রগণ্য। হত্যার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে যেখানটাতে থামিয়ে দেয়া হয়–সেখান থেকেই শুরুটা শেখ হাসিনার। তিনি বহুমাত্রিক প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন গত চার দশকের রাজনীতিতে। নিজেকে পৌঁছে দিয়েছেন অনন্য সাধারণ এক উচ্চতায়। ক্ষমতা, যশ ও খ্যাতির চূড়ায় অবতীর্ণ । কিন্তু তিনিও কী পরম প্রশান্তিতে নিজের দুটি চোখের পাতাকে এক করতে পেরেছেন একটি দিনের জন্য? না, তা পারেননি। ২০০২ সালের ১৮ জুন আমাকে এক সাক্ষাতকার প্রদানকালে বলেছিলেন, আমার জন্য ‘রাত’ বড় বিভীষিকার, বড় বিষাদ-বেদনার এবং ঘোর অমানিশার। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ‘রাত’ কেড়ে নেয় আমার অবর্তমানে বাবা-মা, ভাই-ভাবী, ছোট্ট আদুরে শেখ রাসেল ও আমার আত্মীয়-পরিজনদের। পনেরো আগস্টের রাত যে কেয়ামতের রাত।"
শেখ হাসিনার জীবন বর্ণাঢ্য, কিন্তু বড় বিচিত্র! জীবনের সব শুভের অন্তরালে প্রচ্ছন্ন পিতার দৃশ্যমান শূন্যতা। ‘অশুভ’ বারবার তাঁকে তাড়া করে। অদৃশ্যবাদী করুণাময়ের কৃপায় বারবার ‘অশুভ’ পরাভূত হয়! তাঁর জীবনের মাহেন্দ্রক্ষণগুলো ভীষণ বিস্ময়ের এবং সুগভীর শূণ্যতার। সেই শূণ্যতা, পিতৃত্বের- পিতৃসন্নিধানের!
একটি মানুষের জন্ম-মৃত্যুর মাঝে ঘটে যাওয়া বিষয়গুলোর সম্মিলনই তো জীবনকে সাজিয়ে দেয়। জীবন বর্ণাঢ্য হতে পারে, তেমনি হতে পারে সংক্ষিপ্ত। আবার প্রতিভার আমেজে, কিংবা মেধা ও গুণের মিশিলে জীবন হয়ে উঠতে পারে সুখময় ও সুসমৃদ্ধ। জীবনে বেদনাবিধুর স্মৃতিও থাকে। কমবেশি উত্থান-পতনের স্রোতধারায় বয়ে চলা ঘটনাপ্রবাহের নামই হলো পরিপাটি বা পরিপূর্ণ জীবন, সুখ-দুঃখের জীবন। ঠিক সুখদুখমাখা একটি জীবনের নাম শেখ হাসিনা। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের রহমানের কন্যা যিনি। পিতার ন্যায় শেখ হাসিনাও প্রকৃষ্ট-প্রকৃত জাতীয়তাবাদী নেতা।
শেখ হাসিনার বেড়ে ওঠা জীবনের বিচিত্র গল্পটার শুরু ১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর সূর্যশোভিত রোদেলা দুপুরে। ইতিহাসের কী অদ্ভুত প্রদর্শন! ভারতবর্ষে চারশত বছরের রাজত্বে পালবংশের স্থপতি বুদ্ধিষ্ট রাজা গোপালের ‘গোপালগঞ্জ’-এ ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ জন্ম নেয়া শেখ মুজিবও এক রাজা-মহারাজা। যাঁর নামে মুক্তা ঝরে, নীলাদ্রি আকাশে উড়ে লাল-সবুজের পতাকা, স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের পতাকা। পিতার ন্যায় শেখ হাসিনাও ভূমিষ্ট নদীবিধৌত মধুমতী কোলআঁধারের ছায়াশান্ত পল্লীমঙ্গলারূপী টুঙ্গিপাড়াতে।
শেখ মুজিবুর রহমান ও শেখ ফজিলাতুন্নেছা রেণুর শুভপরিণয় এক রূপকথার গল্প। তেরো বছরের ছিপছিপে রোগাসোগা কিশোর মুজিব। অধ্যয়নে সপ্তমী পার হয়নি চোখপীড়া রোগের কারণে। আর
ফজিলাতুন্নেছার রেণুর বয়স মোটে তিন। মুজিব-রেণু চাচাতো ভাইবোন। বড় অবেলায় হারান পিতাকে। অনাথ শিশুকন্যা। অবুঝ রেণুর বয়োবৃদ্ধ দাদামহ কিশোর মুজিবের পিতা মৌলভি শেখ লুৎফর রহমানের কাছে কাছে দাবি করলেন, ‘লুৎফর তোমার বড়পুত্রের সঙ্গে আমার নাতনি রেণুর বিয়ে দাও। কখন চলে যাওয়ার ডাক আসে, আমি এখনই দু’নাতনির নামে সমস্ত বিষয়সম্পত্তি লিখে দিবো।" মুরব্বি বলে কথা। চাচার আবদার ফেলেন কি করে? তিন বছরের রেণুর সঙ্গে তেরো বছরের মুজিবের ‘নিকাহনামা’ রেজিস্ট্রি হলো ১৯৩৩ সালে। দু’বছরের মাথায় রেণু হারালেন মাকে। শাশুড়ি মা তাঁর সান্নিধ্যে নিয়ে নিলেন পুত্রবধূকে। রেণু, মুজিবের মা সায়রা খাতুনের স্নেহ-মমতা পেতে থাকলো সাত বছর বয়স থেকে। বাল্যবিবাহ বলে তাদের ফুলশয্যায় বিলম্ব। পার হতে হয়েছে বেশ ক’টি বছর। ১৯৪২ সালে হলো মুজিব-রেণু দম্পতির মধুরেণ সমাপয়েৎ- ফুলশয্যা। কলকাতায় ছাত্রনেতা হয়ে ওঠা বাড়ন্ত মুজিব নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের মধ্যমণি। কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ ছাত্রসংসদের জি.এস তিনি। বাংলার প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ভাবশিষ্য হিসাবে শেখ মুজিবের পরিচিতি গড়ে উঠেছে বাংলার রাজধানী কোলকাতা জুড়ে। তাই কোলকাতাই মুজিবের প্রাণ।মাঝেমধ্যে গোপালগঞ্জে আসা।এভাবে এসে গেলো মুজিব-রেণুর দাম্পত্যের কন্যা সন্তান জন্মের মহামূহুর্তটি। মানুষ বেদনা ভিন্ন নয়। আবার বেদনার উর্ধ্বেও থাকে কিছু গৌরব। কিন্তু শেখ হাসিনার জীবনপ্রবাহের স্রোতধারা বিচ্ছিন্ন এবং বিষাদময়। মায়ের গর্ভ থেকে পৃথিবীর আলোর মুখ দেখা শিশুটি পিতার সান্নিধ্য পেলো না। কারণ পিতা মুজিব তখন সুদূর কোলকাতায়। তিনি দেশবিভাগের তন্দ্রাঘোরে, স্বাধীন বাংলার স্বপ্নদ্রষ্টা সোহরাওয়ার্দীর সাহচর্যে। পুত্র মুজিবকে টেলিগ্রাম করে পিতা লুৎফর রহমান জানান নাতনি হবার খুশীর খবরটি। কিন্তু ছুটে আসেননি মুজিব, মেয়ের মুখদর্শন করতে। কোলকাতায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় লাখো লাখো হিন্দু-মুসলমানের জীবন প্রদীপ নিভে গেছে। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর স্বাধীন অবিভক্ত বাংলার স্বপ্নটা তাতেই ধূলিস্যাত। বঙ্গভঙ্গের লীলাখেলায় আবারও বাংলা দ্বিখণ্ডিত হলো। শেরেবাংলা, সোহরাওয়ার্দী, হাশিমের শেষ চেষ্টাটি ছিলো, পাকিস্তানের অধীন পূর্ববাংলার অংশে কোলকাতাকে ফেলার। শেখ মুজিব তাই সন্তান হওয়ার খবরশুনেও ছুটে এলেন না। আশায় বুক বেঁধে ছিলেন। না, তাঁর প্রিয় ‘লিডার’ সোহরাওয়ার্দী তখন মানসিকভাবে বিধ্বস্ত। মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে সোচ্চার পশ্চিম বাংলার মুসলমানদের বাঁচাতে। অবশেষে স্বপ্নভঙ্গ হলে শেখ মুজিব কলকাতার পাঠ চুকিয়ে ঢাকায় এসে ঘাট বাঁধেন।
মানুষের জীবন নামক যন্ত্রটা অকৃত্রিম। নিবুনিবু করে জ্বলে ওঠা প্রদীপশিখার আয়ুষ্কালের যোগবিয়োগে নেই এক পলকের ভরসা। তারপরও মানুষের ক্ষমতা আর ঐশ্বর্য লাভের বাসনা চির-অতৃপ্ত এবং অসীম। কেবল আল্লাহ বা স্রষ্টার অসীমত্বে সমর্পণের মাধ্যমেই মানুষ তৃপ্তি পেতে পারে। আর এভাবেই সৃষ্টিকর্তার কৃপায় মানুষ পেতে পারে রাজত্ব, ক্ষমতা, যশ ও খ্যাতি। যেমনটি পেতে থাকলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি স্বাধীন পাকিস্তানের প্রাদেশিক পূর্ববাংলার রাজধানী ঢাকায় চলে এলেন কোলকাতা থেকে। ভালোদিন পথের বাঁকেই অপেক্ষা করছিলো, যেনোএকটু এগিয়ে যেতে হবে। দ্রুত মুজিবীয় কন্ঠ ভাষাসংগ্রামে। গণমুখে, আড্ডায়-আলাপে। ছাত্রলীগের ময়দানে। সেবক ও সহচরের সংখ্যা দিনে দিনে বেড়ে মুজিব ক্রমে হয়ে ওঠেন এক অজেয় শক্তি। তাতে পারিবারিক অন্তরঙ্গ সম্প্রীতির মায়াজাল ছিন্ন হলো। একজন ছিপেছিপে, দীর্ঘদেহী, ঘনওল্টানো চুল মাথায়, খবরের কাগজ হাতে দাঁড়ানো শেখ মুজিবের জ্বালাময়ী ভাষণ একদিন স্বপ্ন দেখালো স্বাধীনতার। এর গভীর প্রভাব পড়লো পরিবারের ওপর। যেমনটি শেখ হাসিনার ওপর। তাঁর জীবন খুবই ঘটনাবহুল।
১৯৫৩ সালে মুজিব আরমানিটোলাস্থ ৮/৩, রজনীবোস লেনস্থ এক আত্মীয়ের বাসায় নিয়ে আসেন পরিবারকে। প্রিয় সহধর্মিণী শেখ ফজিলাতুন্নেছা ছিলেন সর্বংসহা, ধৈর্যের এক প্রতিমূর্তি। শত দুঃখ-কষ্টের মাঝেও যিনি এক মুহূর্তের জন্য হননি বিচলিত। সংগ্রামী স্বামীকে অহর্নিশ প্রেরণাদানকারী এক মহীয়সী নারী। মরণেও হয়েছেন স্বামীর সঙ্গী। সেই সুরমনী ফজিলাতুন্নেসার পরিবারের গল্প অশ্রসজল করে দেয় চোখ।