ঈশিকা মুন: পর্ব -১
পেট পুরে পান্তাভাত খেয়ে কাজে নেমে গেলো জহির। আমেনা কি খেয়েছে না খেয়েছে তা আর খোঁজ নেয়ার জো নেই তার। ক্ষিধের জ্বালায় পৃথিবীর এতটুকু সত্যি সে বুঝে নিয়েছে যে, পেটের ক্ষুধায় বাঘ ও তার সন্তান কে চেনেনা। সেখানে আমেনা তো তার ঘরের বউ। যে বিয়ের তিন বছরেও জহিরকে একটা বাচ্চার মুখ দেখাতে পারলোনা। এসব ভাবতে ভাবতে কলার মোচার মত ছোট্ট নৌকা নিয়ে জাল নিয়ে বের হয়ে গেলো জহির, যদি একটা মাছ ধরা পড়ে তাহলে তো খাওয়া ও জুটলো, চাল ও কেনা হলো নতুন। যাওয়ার সময় আমেনাকে কোথাও দেখা গেলো না।
-মাগীডা কামের সময় কই থাহে কেডা জানে। সোয়ামীরে যে যাইবার কালে দেহা দিতে অয় বাপ মায় হেও শিখায় নায়।
আমেনা স্বামীর খবর নিবেই বা কিভাবে দুই দিন ধরে যে তার পা ফুলে আছে খুব বেশী৷ ঘোষদের বাগানের লেবু আনতে গিয়ে কিসের এক কাঁটা পায়ে লেগেই তার এই অবস্থা। জহির তো ফিরেও তাকায়না। দুই দিন ধরে ব্যাথায় আমেনার গোঙানি পর্যন্ত তার কানে পৌঁছায়নি৷ হলুদ বেটে পায়ে লাগানোতেই ব্যস্ত ছিলো আমেনা। ঘরে পান্তা পর্যন্ত নেই যা খেয়ে পেট শান্ত করবে সে। যা ছিলো সবই জহিরের সামনে দিয়ে আসে সে আর নিজের জন্য রাখে সেই পান্তার কিছু পানি। মরিচ পুড়িয়ে নিয়ে তা দিয়ে পানিটা খেয়ে নেয় সে। চৈত্রের এই টুটা ফুটা ধু-ধু দেহঝলসানো দুপুরে বনে বনে বাদাড়ে ঘুরে, এ বাড়ি ও বাড়ি দৌঁড়ে এটা ওটা জোগাড় করে রান্না করতে বসে আমেনা। ঘরে চাল নেই মোটেও।
ভাত-ডালের হাড়ি গড়াগড়ি করছে উঠোনে। আমেনা বিপুলদের ঝোঁপ থেকে দুটো মানকচু কেটে নিয়ে এসেছে। মানুষটা কচুবাটা খুব পছন্দ করে এই ভেবেই আমেনা রান্নাতে মন দেয়। ক্ষিধেয় নিজের পেটে আগুন ধরে গেলেও জহিরের খাওয়া নিয়ে চিন্তায় তার দিন কাটেনা। কচু কেটে, ধুয়ে, বেটে নিলো ভালো করে, কিছু সরিষা দিয়ে দিলো আর গোটাকয়েক কাঁচা লঙ্কা। কিঞ্চিৎ গন্ধ হয়ে যাওয়া নারকোল কোরানো ছিলো তাও বেটে নিলো। দুমোঠো ভাত হলেই হয়ে যেতো। চালের খোঁজে বের হতে হবে আমেনাকে। মন্টুর মায়ের কাছে গিয়ে চাল চাওয়া তার কাছে লজ্জার বিষয়। বিধবা স্ত্রী সন্তানকে নিয়ে কোনোমতে দিন কাটায় এর মধ্যে আমেনাকে দেবার সামর্থ্য কই তার। একটু দূরে বড়বাড়িতে বউ-ঝিদের হাড়ি-পাতিল ধুয়ে দিয়ে, মাছ-শাক কেটেকুটে দিলে যদি কিছু চাল পাওয়া যায় এই চিন্তায় আমেনা বের হয়ে পড়ে। চুলের গুছিটা ভালোমতো খোঁপা করে, কাপড়ের আঁচল গুছিয়ে নেয় সে। চৈত্রের দুপুরে ঘরের বাইরে কড়া রােদ, গরম বাতাস। শরীর যেন পুড়ে যাচ্ছে তার।
ধান মাড়াইয়ের শব্দের আড়ালে যেন কারো হাসির শব্দ শোনা যায়। আমেনা উঁকি মারতেই দেখে বড় বাড়ির মিজান মোল্ল্যার ছেলে আনিস আর রহিমার মেয়ে পুটি হাত ধরাধরি করে আছে। আমেনাকে দেখে সেখান থেকে পুটি ভয় পেয়ে পালিয়ে যায় আর আনিস মুখ কাচুমাচু করে থাকে, আমেনা একটা হাসি দিয়ে বাড়ির ভেতরে চলে যায়। কাপড় কাচা আর পানি আনার কাজ পেয়ে যায় আজকের মতো আমেনা। পেছনের পুকুরপাড়ের দিকে কাপড় শুকাতে গিয়ে সে খেয়াল করে এই বাড়ির বড় মেয়ের জামাই মকবুল অনেক সময় ধরে তার দিকে তাকিয়ে আছে। আমেনা কাপড়ের আঁচল ভালো করে বুকে জড়িয়ে নেয়। মকবুল এগিয়ে আসে ,
-কি আমেনা কেমন আছো?
-হয় ভাইজান ভালো আছি।আপনে কবে আইলেন?
মকবুলের দৃষ্টি যেন আমেনার রোদে ঝলসে যাওয়া শরীরের দিকে। পানের পিক ফেলতে ফেলতে মকবুল জানায় যে সে গতকাল এসেছে।
-তোমার সোয়ামী কি তোমারে খাওন দেয়না? আহারে! এই ভরা যৌবন দুধের মত গায়ের রং তো চিমশাইয়া যাইতেছে।
- ভাইজান যে কি কন!
ওখান থেকে সরে পড়ে আমেনা। এই ধরনের পুরুষদের তার জানা আছে,কথার ছলে গায়ে হাত রাখে। কাজ শেষে একটা পাতিলে কিছু চাল, খেসারি ডাল আর কয়েকটা কলা নিয়ে বাড়ি ফেরে সে। বাড়ি ফিরে এসে দেখে উঠোন ঝাড়ু দেয়া,হাড়ি-পাতিল সব ধুয়েমুছে সাফ করা আছে। উঠোনে একটা কলার কাঁদি,কলার মোচা। আমেনা ঘরে কাউকে খুজে না পেয়ে উঠোনে ফের নামতেই কেউ তার চোখ চেপে ধরলো। হাতটা স্পর্শ করতেই আমেনার বুকের মধ্যে হু হু করতে লাগলো। জহিরের ছোট ভাই ছবির এসেছে।
হাত সরিয়েই ভাবীকে নিয়ে মশকরা করে সঙ্গে ছবির। বিয়ের আগে থেকেই জহির বাবা-মায়ের কাছ থেকে আলাদা থাকে। টিনের চাল,বেড়া আর একটা উঠোন নিয়েই সে খুশি। বছরে একবার ও বাপ-মা কে দেখতে যায়না সে। ছবির শুধু আসে দেখা করতে তাদের সাথে।
ব্যাগ থেকে ছবির আরও কত কি বের করে । আড়াই সের মুগের ডাল, আড়াই পােয়া মিছরি আর গায়ে মাখার একটা সাবান,ভাইয়ের জন্য একটা লুংগি।
আমেনা আহলাদ করেই বলে-
আমার লইগ্যা কি আনছো মিয়া?
আনছি আনছি। হাত পাতো আমি দেতাছি।
হাত বাড়াতেই কাঁচের এক মুঠো চুড়ি ধরিয়ে দেয় ছবির তার হাতে। চুড়ি পেয়ে আমেনা অনেক খুশি হয়। গঞ্জে ছবিরের মুদির দোকান আছে।জহিরের মতো সে অশিক্ষিত না। মূর্খ-চাষা জহিরের চেয়ে ছবির ভারী রসিক মানুষ। বয়সে এক দুই বছরের ছোট হবে সে জহিরের চেয়ে কিন্ত বুদ্ধি আর অর্থের বেলায় অনেক আগানো। আমেনা তাড়াতাড়ি চাল বসায় হাড়িতে। আর ডাল রান্না করতে বসে পড়ে, দেবর এসছে তার তো শুধু কচুবাটা তে আর হবেনা। ছবির বাড়ির বেড়া ঠিক করতে বসে। আমেনা শুধু দেখে আর অবাক হয়। কত কাজ করতে ওস্তাদ এই মানুষ টা জহিরের মত আলসে না সে৷
-আইতে না আইতেই এত কাম করতে লাইগ্যা গেলা মিয়া৷
- কি আর করুম। বেড়া যদি ঠিক কইর্যা না দেই তোমার যে রুপ, সবই তো পুইড়া যাইবো।
- কি যে কইতাছো তুমি মিয়া!
আমেনা হাত দিয়ে ছবিরের মাথায় আলতো বাড়ি মেরে কলসি নিয়ে বের হয়ে যায়৷ হাতে পড়া চুড়িগুলো নিয়ে নাড়িয়ে কলসিতে পানি ভরতে তার ভালোই লাগছিলো। গত বার মেলায় এই চুড়ি কেনার শখ ছিলো তার। বাড়ি ফিরে নতুন উঠোনো বেগুনি রঙ এর কালো ডোরা শাড়িটা নিয়ে গোসলে যায় সে৷ আজ কি মনে এই শাড়ি পরতে তার ইচ্ছা হলো সে ও জানেনা। বুক ঢিপঢিপ করতে থাকে তার ছবির আসার পর থেকেই।
ফিরে এসে দেখে জহির আর ছবির মিলে গঞ্জের আলাপ আলোচনা করছে। জহির আজ ভালোই মাছ পেয়েছে। আমেনা দুই ভাইকে ভাত বেড়ে দিয়ে নিজে মাছ কুটা শুরু করে। জহির হাত মুখ ধুয়ে খেতে বসে। ছবির জিদ করে, ভাবীকে ছাড়া সে খেতে পারবেনা। আমেনার হাত ধরে জোর করে এনে তাকে খেতে বসায়। খেতে বসে ছোটবেলার কথা মনে করে ছবির, কিভাবে বড় ভাইয়ের পিছনে ডুলা নিয়ে ঘুরতো সে, মাছ ধরার জন্যে। চিংড়ি আর বেলে মাছ পেয়ে নিলেই সেইসব সময় তাদের জন্য ছিলো ঈদের মত আনন্দ।
-আইজ খালি টাটকিনি মাছ পাইছি বেশি।ভাবছি বেচুম তয় বেচি নায়। নিজের পেটডায় তো দেওন লাগে।
ভাইয়ের সংসারের অভাব অনটন এর ছাপ তার মুখেই লেগে আছে এটা ভেবেই ছবির এর মন খারাপ হয়। খেয়ে দেয়ে দুই ভাই ঊঠান থেকে সরে ঘরের কোনায় মাদুর পেতে শুয়ে পরে।আমেনা ঘরের কাজ সারে।
আমেনা সন্ধ্যা বেলা ফুলির মার কাছে গিয়ে একটু পিঠা বানানোর জন্য তেল আনে।
- আত্মীয়-কুটুম্বরা বাড়িত আইলে কিছু যে কইর্যা খাওয়ামু হেই জো নাই গো ফুলির মা। পিঠা বানাইলে আমি ফুলির লইগ্যা কয়ডা দিয়া যামু আনে খাইও তুমিও।
সন্ধ্যার তারা টাকে কেমন জানি পোয়াতি মনে হচ্ছে তার। নিজের বাচ্চা নেই বলে কম আফসোস ও নেই তার মনে। কিন্ত অন্য সব পুরুষ মানুষের মত জহির তো আর একাধিক বিয়ে করেনি এই একটা সান্ত্বনা আমেনার মনে। বাড়ি ফিরে,কিছু পিঠা বানিয়ে ফেলে সে। জহির যে মাছ ধরেছে তার মধ্য থেকে ছোট শিলন মাছ গুলো ভেজে ফেলে। জহির আর ছবির কেউ ই ঘরে নেই। দোকানপাটে গেছে হয়তো। মৃধা বাড়ির টুকি আসে তার চুলার পাশে।
-হুনলাম তোমার দেওর আইছে। আমাগো তো একটু ডাকলা না।
- হয়,ডাকলে তো কত আইতা।তয় আমার দেওর রে দেহনের এত সখ ক্যা মাগি তোমার!
-আরে ভাবি কি যে কউ না তুমি।তোমার দেওর এর নাহান পুরুষ কি আর সাত গ্রামে আছে।
দুজনেই খিলখিলিয়ে হাসে। সেই হাসি যেন চুড়ির আওয়াজ এর মতন বেজে ওঠে পুরো উঠোন জুড়ে।টুকির সাথেই আমেনার একমাত্র বন্ধুত্ব ভালো। মনের সব কথা সে টুকিকেই বলে। দুজনের মধ্যে মিল ও অনেক। বিকেল হলেই দুজনে যাবতীয় টক যাই পাবে ভর্তা করে তেতুল দিয়ে বানিয়ে খেয়ে নিবে।জহির যখন মাঝেমধ্যে রাতে বাড়ি ফেরেনা তখন টুকি এসে আমেনার সাথে ঘুমায়। সন্ধ্যা বাড়লে টুকি চলে যায়।আমেনা গিয়ে ছবিরের জন্য বিছানা গুছায়৷ ছবিরের জামা কাপড় ও গুছিয়ে রাখে।নতুন এক শিশি তেলের বোতল দিয়ে রাখে তার বিছানার পাশে। গোসলের জন্য আলাদা গামছা। মাথা আঁচড়ানোর চিরুনি আর আয়না৷
রাতে বাড়ি ফিরে খেয়ে দেয়ে সবাই ঘুমিয়ে যায়।পরদিন সকালে মাছ ধরবার জন্য ডাক পায় জহির। নৌকায় কয়দিন থাকা লাগে এই চিন্তায় আমেনা কিছু মোয়া আর আলাদা মুড়ি একটা গামছায় করে তাকে দিয়ে দেয়। সাথে প্রয়োজনীয় সব কিছু। জহির যে কয়দিন বাহিরে থাকবে ঘর বাড়ি দেখতে ছবির কে রেখে যায়। দু একটা বেশি টাকার লোভেই জহির এবার বের হয়।এই সুযোগ সে সহজে পায় না বড় খ্যাপ না দিলে হাতে টাকা থাকেও না। গত আশ্বিনে মাছ ধরার ডাক পেয়েছিলো কি পায়নি, নিজেই যা ধরে আর বিক্রি করতে পারে।তাতে টেনে টুনে সংসার চলে। এবার কিছু টাকা বেশি হলে একটা গঞ্জে দোকান দিবে এই তার শখ।
বেশ কয়দিন হলো ছবির ঘরের সব কাজ lই করছে। বসে থাকার লোক সে নয়। এই দুই-তিনদিনেই আমেনাদের উঠোন আর ঘরের চেহারাই সে পাল্টে দিয়েছে।টুকি ও ইদানীং এখানেই বেশি থাকে।আমেনার কাজ কমে গিয়েছে অনেক।রান্না বান্নাতেও ছবির মাঝেমধ্যে হাত লাগায়। টুকি খুব সেজেগুজেই আসে।আমেনা সব ই খেয়াল করে।